শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২২ অপরাহ্ন
মাহমুদ হাসান, মোংলাঃ আজ ১৫ নভেম্বর, এই দিন প্রলংকারী ঘুর্নিঝর সিডর’লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল দক্ষিনাঞ্চলে জনপথসহ গোটা সুন্দরবন। সেদিন প্রান হারিয়েছিল অনেক মানুষের, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল উপকুলীয় এলাকার জান-মাল ও মানব সম্পদের। যদিও সরকারি হিসাব মতে জেলায় মোট নিহতের সংখ্যা ৯০৮ জন, আহত ১১,৪২৮ জন, নিচিহ্ন হয়ে যায় মানুষের ঘরবাড়িসহ সকল সহায়-সম্পদ। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে শতাব্দীর ভয়বহতম ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে দেশের ৩০টি জেলার ১৯৫০টি ইউনিয়নের ৮৯’লাখ ২৫’হাজার মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের পাশাপাশী সুন্দরবনের অসংখ্য বন্যপ্রানীর মৃত্যু ঘটে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডব থেকে রক্ষা পেতে সেদিন মোংলা উপজেলার অনেক মানুষ ঠাঁই নিয়েছিল আশ্রয়কেন্দ্রে। তাদেরই একজন উপজেলা চিলা গ্রামের জর্জি সরকার ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সাথী সরকার। অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচাতে ওই দিন বিকেলে তাঁরা গিয়েছিলেন স্থানীয় সেন্ট মেরিস গির্জা-সংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। ঝড়ের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সাথীর প্রসববেদনা। সকালের আলো ফোটার আগেই তাঁর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একপি পুত্র সন্তান।
প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলার মধ্যে নতুন প্রাণের বারতা বয়ে আনল যে শিশুটি, মা-বাবা তার নাম রাখলেন সিডর। পুরো নাম সিডর সরকার। ঘূর্ণিঝড়ের ১১ বছরের সঙ্গে সঙ্গে সিডরও ১১ বছরে পা দিচ্ছে। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের চথুর্থ শ্রেনির ছাত্র সে। প্রকৃতির রুদ্ররোষ মাথায় নিয়ে যে শিশু পৃথিবীতে এসেছিল, তার সংগ্রাম এখনো চলছে। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে সিডর ও তার পরিবার। উপকুলীয় আর ১০টি পরিবারের মতো নিদারুন অভাব পিছু ছাড়েনি সিডরের পরিবারের। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চিলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সিডরের বাবা জর্জি সরকারের বসতভিটা পড়ে আছে, কোনো ঘর নেই। প্রতিবেশীরা জানালেন, তাঁরা এখন আর এখানে থাকেন না। দেনার দায়ে ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁরা এতোদিন থাকতেন গ্রামেরই এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তবে সরকারের দেয়া প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ন প্রকল্প-২ থেকে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রবিউল ইসলাম সিডরকে এক খানা ঘর দিয়েছেন। এখন সেখানেই বসবাস করছেন সিডর ও মা-বাবা।
খুঁজতে খুঁজতে দেখা মিলল সিডরের দাদি রিভা সরকারের সাথে। তিনি সাংবাদিক দেখে তাদের নিয়ে গেলেন গোলপাতায় ছাওয়া ছোট্ট একটি ঘরের সামনে। বসতে দিলেন কাঠের পিঁড়িতে। বললেন, এই ছোট ঘর তাঁর চাচাতো বোন সুনীতা ঘোষের। দেনাগ্রস্ত পরিবারটিকে এখানে সিডর ও তার মা-বাবাসহ তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছেন সরকারের দেয়া একটি ছোট্র ঘরে। কিছু সময় পরেই দেখা মিলল সিডরের বাবা জর্জি সরকার। তিনি বললেন, গত দুই বছর পুর্বে সিডরের দাদা রঞ্জিত সরকারের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অবাবে মারা যায় সে। অভাবের সংসার, এখন তাঁরা ঋণের জালে জর্জরিত। বাধ্য হয়েই তিনি ২২ হাজার টাকায় পুরানো থাকার ঘরটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তার পর থেকেই অন্যের কাছ থেকে নৌকা ধার করে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ, কাঁকড়া ধরতে যান। সিডরের মা সাথী সরকার সিডরকে লেখাপড়প শিখানোর জন্য ঢাকায় এক আতœীয়ার বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। সাংবাদিক এসেছে একথা শুনে সিডরের সাথে দেখার করার কথা বলে বিদ্যালয় থেকে ছুটি দেওয়া হয়। দেখা গেলো ছোট বেলার মতোই শান্ত সিডর এক দৌড়ে বাড়িতে এল। কিন্ত চলাফেড়া ও লেখাপড়ায় প্রকৃতির মতোই দুরন্ত সে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করে না? হাসিমুখটা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। অভিমান ভরাউত্তর, ‘মা তো অনেক দূরে কাজ করে। তবে সে এখন বুঝতে শিখেছেন, বলেলন, মা বলেছেন আমার লেখাপড়ার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন তাই আমার ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছেন মা। তাই ইচ্ছা করলেই আসতে তো পারে না।